সমাজে কিছু মানুষের আগমন ঘটে চারদিকে আলো ছড়াতে। জীবদ্দশায় তাঁরা স্ব-মহিমায় ও ব্যক্তিত্ব গুণে এমন একটা মর্যাদার আসন প্রতিষ্ঠা করেন যা পরলোক গমনের পরেও আলোচনার বিষয় হয়ে থাকে। প্রিয় বন্ধু ড. মুহম্মদ মনিরুজ্জামান ছিলেন তেমন একজন মানুষ যার গুণকীর্তন স্বল্প পরিসরের লেখায় সম্ভব নয়। তিনি ছিলেন একাধারে প্রথিত যশা শিক্ষক, সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মী, ইতিহাস গ্রন্থ প্রণেতা, প্রবন্ধকার, গবেষক, সুবক্তা, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধেরও সংগঠক, সদালাপী, বন্ধুবৎসল, হাসি-খুশি স্বভাবের একজন নিরেট ভদ্র মানুষ।
গত ২ সেপ্টেম্বর ২০২২ সকালে দিনাজপুর থেকে এক সময়কার সহকর্মী, সুহৃদ প্রফেসর আব্দুল মাজেদ জানান, দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ঐ দিন সকাল ৭.০০টায় তার জীবনাবসান হয়েছে (ইন্না লিল্লাহি…রাজিউন)। সংবাদটা শুনে খুব মনব্যাথা অনুভব করেছি। দীর্ঘদিন একসাথে পথ চলা একজন কীর্তিমান বন্ধু চিরদিনের জন্য চলে গেছেন এটা গভীর পরিতাপের বিষয়। জীবদ্দশায় তার চারপাশ ঘিরে থাকত প্রতিভাধর মানুষেরা সকলের মাঝে থেকেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম সে মানুষটা আর কোন দিন কর্মক্ষেত্রে ফিরবেন না ভাবলে একটা শূন্যতা মনকে গ্রাস করে।
ড. মুহম্মদ মনিরুজ্জামান যিনি বন্ধু মহলে জামান ভাই বা জামান সাহেব হিসেবে পরিচিত ছিলেন ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে জানত জামাল স্যার হিসেবে। চার শতাব্দীর লালমনিরহাট গ্রন্থের পেছনের কভার পৃষ্ঠায় তাঁর যে সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে তাতে দেখা যায় তাঁর জন্ম ১৯৪৫ সালে দিনাজপুর শহরের উত্তর বালুবাড়িতে। তাঁর শিক্ষা জীবনের প্রথম স্তর শেষ হয় দিনাজপুরে। ১৯৬০ সালে তিনি দিনাজপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্টিকুলেশন পাশ করেন পরে আইএ পাশ করেন রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে। অতঃপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে অনার্স ও ১৯৬৬ সালে মাস্টার্স (ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি) তে পাশ করেন। শিক্ষা জীবন সমাপ্তির পর তিনি ১৯৯৬ সালে ইনিস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল “Zamindars of Bengal: Case Study of Selected Rangpur Zamindars (১৭৯৩-১৯৫০)। এই ডিগ্রীটি করেন কারমাইকেল কলেজের অধ্যপনা করার সময়।
মুহ. মনিরুজ্জামান কর্মজীবনের প্রথমে শুরুতে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী ডিগ্রি কলেজে যোগ দেন। পরে ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে চলে আসেন লালমনিরহাট কলেজে। অত্র কলেজে অধ্যাপনা করাকালীন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম আরম্ভ হলে তিনি স্বপরিবারে চলে যান ভারতের কোচবিহারে। সে সময় আমাকেও স্বপরিবারে ভারতে গিয়ে কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমা সংলগ্ন এলাকায় আশ্রয় নিতে হয়েছিল তার সাথে আমার পরিচিতি ঘটে। তিনি ছাড়াও লালমনিরহাট কলেজের তদানিন্তন অধ্যক্ষ শামসুল হক, অধ্যাপক নীলকান্ত ব্যাপারী, মুহ. বদিউর রহমান, ভারতের কোচবিহারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে থাকা কালে আমরা চারজন কোচবিহারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সাথে সংঘবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে মিটিং মিছিল ও অন্যান্য কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছি। কোচবিহার শহরে আমরা জোনাল প্রশাসক ফয়েজ আহমদের সহায়তায় বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে তাতে শিক্ষকতা করেছি। কোচবিহার শহরে রাসের মেলা আরম্ভ হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য স্টল দিয়েছি। তদানিন্তন জোনাল চীপ মতিয়ার রহমান ও অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সাথে মতবিনিময় করে সকলকে আমাদের কার্যক্রম অবহিত করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তির পর তিনি ফিরে এসে লালমনিরহাট কলেজে যোগ দেন আর আমাকে যোগ দিতে হয় পাটগ্রাম জসমুদ্দিন কাজী আব্দুল গণি কলেজে।
পরবর্তীতে তদানিন্তন এমপিএ আবুল হোসেনের সহায়তায় আমাকে লালমনিরহাট কলেজে ১৯৭৩ সালে চলে আসতে হয়। তারপর থেকে জামাল ভাইয়ের সাথে পেশাগত জীবনের পথ চলা শুরু হয়। এর মাঝে ১৯৮৪ সালে কলেজ সরকারিকরণ হলে তিনি সহকারী অধ্যাপকের পদে যোগ দেন এবং একটানা অনেকগুলো বছর সে পদে থেকে নব্বইয়ের দশকে রংপুর কারমাইকেল কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তাঁর আর একটা প্রমোশন হলে তিনি প্রফেসর পদে যোগ দেন বেগম রোকেয়া সরকারি কলেজ রংপুরে। অতঃপর উক্ত কলেজ থেকে তিনি শিক্ষকতা জীবনের সমাপ্তি টানিয়ে অবসরে যান ২০০৩ সালে।
শিক্ষকতা ছাড়া তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ততা বিষয়ে তাঁর রচিত চার শতাব্দীর লালমনিরহাট ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। কলেজে সুদীর্ঘ ৩৫বছর আঞ্চলিক ইতিহাসের উপর তার বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ এসিয়াটিক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) এর আজীবন সদস্য। তাছাড়াও তিনি লালমনিরহাট রোটারী ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট (১৯৮৫-৮৭)। মৃত্যুর আগেও তিনি জাতীয় যক্ষা নিরোধ সমিতি (নাটাব) দিনাজপুর জেলা শাখার সহ-সভাপতি ছাড়াও স্থানীয় বহু জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন।
ড. মনিরুজ্জামান ছিলেন বহু গুণের অধিকারী এক বিনয়ী মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার ও পরে একসাথে অধ্যাপনা করার সুবাদে তাঁর ব্যক্তি জীবনের অনেক কিছু জানতে পেরেছি। তিনি ছিলেন দিনাজপুরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। দিনাজপুর শিক্ষক সমিতির এক সভায় তাঁর সাথে তাঁর বাড়িতে গেলে তাঁর পিতা আলহাজ্ব মফিজ উদ্দিন আহমদ, বড় ভাই মোজাম্মেল হক ছোট ভাই মোছাদ্দেক, মোকাররম, আকতার হোসেন ও ছোট বোন আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন। তারা শিক্ষক সমিতির ঢাকা থেকে আগত সকলকেও আপ্যায়ন করে। সেদিনের কথা এখনও আমার মনে আছে।
ড. মুহম্মদ মনিরুজ্জামান একজন কর্মী পুরুষ। লালমনিরহাটে অবস্থানকালে কলেজ উন্নয়নের কাজের সাথে তিনি জড়িত ছিলেন। কলেজের আর্থিক দৈন্যতা দূর করতে প্রদর্শনী, কলেজ কৃষি খামার, কলেজের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন সবখানে তিনি নিরলস কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। কলেজের ছাত্র আন্দোলন নির্বাচনসহ বিভিন্ন সময় উদ্বৃত্ত দূর্যোগে তিনি সামনে থেকে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছেন। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-কর্মচারীদের সাথে ছিল তার সুসম্পর্ক। কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন ছাড়াও গভর্নিং বডিতে সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। কলেজ ছাত্র সংসদের ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক হিসেবেও দু’একবার যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে। অনেক ক্ষেত্রে কলেজের বিনোদন মূলক কর্মসূচির তত্ত্বাবধান করেছেন তিনি। কলেজ সরকারি করণের সময় তাঁর ভূমিকা ছিল জোড়াল। তাঁর সাথে বার বার ঢাকা গিয়ে সরকারি করণের বিষয়ে প্রচেষ্টা চালিয়েছি। কলেজের কার্যক্রম ছাড়া লালমনিরহাটে রোটারী ক্লাব স্থাপনে তাঁর ভূমিকা ছিল স্মরণ রাখার মত। তিনি ছিলেন ক্লাবের চার্টার প্রেসিডেন্ট।
রোটারী ক্লাব অব লালমনিরহাট তাঁর স্মরণে গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ যে শোকসভার আয়োজন করে তাতে বিভিন্ন বক্তা তাঁর অবদানের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলেন, তিনি ছিলেন একজন সুপন্ডিত, সু-বক্তা, সংগঠক, বিনয়ী মানুষ। চলবে বলনে ছিলেন পরিচ্ছন্নও অমায়িক ব্যবহারের। পরে তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করে পরম করুণাময়ের দরবারে মোনাজাত করা হয়। অনুষ্ঠানে মোবাইল কলে যুক্ত হন প্রফেসর হামিদুল হক মন্টু, ড. জামানের স্ত্রী মেরিনা জামান, ছেলে ভুলন ও মেয়ে মনা। মন্টু, ড. জামানের কীর্তিময় জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, তিনি ছিলেন জ্ঞানে ও গুণে একজন আদর্শ মানুষ। তাঁর মৃত্যুতে শুধু তাঁর পরিবারের জন্য নয়, সমাজের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। তাঁর মৃত্যুতে দেশের প্রতিভাধরদের মাঝে যে শূন্যতা সৃষ্টি হল তা পুরণ হবার মত নয়।
মানুষ মরণশীল। জন্ম গ্রহণের পর মানুষকে একদিন ধরাধাম ত্যাগ করতে হয়। ড. মনিরুজ্জামান গত ২ সেপ্টেম্বর চিরদিনের জন্য পরলোকে চলে গেছে। পেছনে রেখে গেছেন শোকার্ত স্বজন আর অগণিত ভক্ত গুণাগ্রাহী। পরম করণাময়ের কাছে প্রার্থনা তিনি যেন তাঁর স্বজনদেরকে শোক ভোলার সামর্থ দেন আর তাঁকে যেন প্রদান করেন বেহেস্তের উচ্চাসন।
তথ্য সূত্র:
১। চার শতাব্দীর লালমনিরহাট- ড. মুহ. মনিরুজ্জামান, প্রকাশ কাল- ফেব্রুয়ারী-২০০৮।
২। মেরিনা জামান, ড. জামানের স্ত্রীর কাছ থেকে নেয়া তথ্য।
৩। রোটারী ক্লাব অব লালমনিরহাটের স্মরণ সভা তারিখ: ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২।
(লেখক অবসর প্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক সরকারী কলেজ ও সাহিত্য গবেষক, লালমনিরহাট)